শনিবার, ৩০ নভেম্বর ২০২৪, ১০:২৮ অপরাহ্ন
আমার সুরমা ডটকম : বিএনপি সমর্থক আইনজীবীরা বিচারপতি এসকে সিনহার বক্তব্যে জোর সমর্থন দিয়ে বলেছেন, এরমধ্য দিয়ে প্রমাণিত হল যে ত্রয়োদশ সংশোধনী বাতিলের রায় ‘অবৈধ’ ছিল। অ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম মনে করেন, ন্যায়বিচার পাওয়ার উপর গুরুত্ব দিতে গিয়ে এই বক্তব্য এসেছে প্রধান বিচারপতির। তবে ঘোষিত রায় পরে লেখা বেআইনি মনে করছেন না তিনি। বিচারপতিদের অবসরের পর রায় লেখার দীর্ঘদিনের এই চর্চায় কোনো সমস্যা একদমই দেখছেন না সাবেক আইনমন্ত্রী শফিক আহমেদ। দায়িত্ব পালনের বছর পূর্তিতে দেওয়া এক বাণীতে প্রধান বিচারপতির ওই বক্তব্যের প্রতিক্রিয়া বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমের পক্ষ থেকে জানতে চাইলে আইনজীবীদের এরকম নানা মত পাওয়া যায়। এ বিষয়ে সর্বোচ্চ আদালতের অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতি সৈয়দ আমিরুল ইসলাম বলেন, দায়িত্ব পালনের সময় ঘোষিত রায় অবসরে যাওয়ার পর লেখার ক্ষেত্রে আইনি কোনো বাধা দেখছেন না তিনি। রায় লিখতে কোনো কোনো সহকর্মীর দেরিতে উষ্মা প্রকাশ করে বিচারিক এই দায়িত্ব কর্মজীবনেই শেষ করতে বাণীতে তাদের প্রতি আহ্বান জানিয়েছিলেন বিচারপতি সিনহা। তিনি বলেন, “কোনো কোনো বিচারপতি রায় লিখতে অস্বাভাবিক বিলম্ব করেন। আবার কেউ কেউ অবসর গ্রহণের দীর্ঘদিন পর পর্যন্ত রায় লেখা অব্যাহত রাখেন, যা আইন ও সংবিধান পরিপন্থি।” অবসরের পর রায় লেখা বেআইনি বলার ব্যাখ্যায় বিচারপতি সিনহা বলেন, “কোনো বিচারপতি অবসর গ্রহণের পর তিনি একজন সাধারণ নাগরিক হিসেবে গণ্য হন বিধায় তার গৃহীত শপথও বহাল থাকে না।” সুপ্রিমকোর্ট আইনজীবী সমিতির সাবেক সভাপতি ব্যারিস্টার শফিক বলেন, যখন বিচারপতি রায় ঘোষণা করেন, তখন তিনি বিচারক হিসেবে শপথে ছিলেন। ঘোষিত তারিখের দিন হিসেবেই রায়ে সই করা হয়। এই চর্চা দীর্ঘদিনের। এ চর্চা ভারত, শ্রীলঙ্কা ও পাকিস্তানে, এমনকি ইংল্যান্ডেও আছে।
সাবেক আইনমন্ত্রী শফিক আহমেদ : “অবসরের পরে রায় লেখা যদি অসাংবিধানিক হয়, তাহলে মাসদার হোসেন মামলাসহ অনেক মামলাই হয়ত টিকবে না। কারণ মাসদার হোসেন মামলার রায় বিচারপতি মোস্তফা কামাল অবসরে যাওয়ার পরে লিখেছিলেন,” বলেন শেখ হাসিনার বিগত সরকারের আইনমন্ত্রী। এ বিষয়ে রাষ্ট্রের প্রধান আইন কর্মকর্তা অ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম বলেন, “প্রধান বিচারপতি রায়ে সই করার ব্যাপারে যে বক্তব্য দিয়েছেন, এটা আমার বিশ্বাস বর্তমান যে পরিস্থিতি এ বিষয়টি বিবেচনা করেই দিয়েছেন। “কারণ হাই কোর্টে একটি কথা উঠছে, অনেক রায় অনেক আগে হয়ে গেছে, সই হয়নি ইত্যাদি। রায় ঘোষণার পর পরই রায় যাতে জনসাধারণ পায়, এই উদ্দেশ্য থেকে উনি কথাগুলো বলেছেন বলে আমি মনে করি।” তবে ঘোষিত রায় পরে স্বাক্ষরে কোনো সমস্যা দেখছেন না সুপ্রিম কোর্ট আইনজীবী সমিতির সাবেক সভাপতি মাহবুবে আলম। “নিশ্চয়ই কোনো বিচারপতি অবসর গ্রহণের পরে রায় ঘোষণা করতে পারেন না। কিন্তু যে রায়টি ঘোষিত হয়েছে তিনি বিচারপতি থাকা অবস্থায়, তারপর তিনি অসুস্থ থাকতে পারেন, উনি যদি পরে সই করেন, তা অসাংবিধানিক বলে আমি মনে করি না।” সুপ্রিম কোর্ট আইনজীবী সমিতির সভাপতি খন্দকার মাহবুব হোসেন প্রধান বিচারপতির বক্তব্যে জোর সমর্থন জানিয়ে বুধবার সংবাদ সম্মেলন করেন। প্রধান বিচারপতির এই বক্তব্যকে ত্রয়োদশ সংশোধনী (তত্ত্বাবধায়ক সরকার পদ্ধতি বিলুপ্ত) বাতিলের রায়ের সঙ্গে সম্পর্কিত করেছেন বিএনপি চেয়ারপারসনের এই উপদেষ্টা।
সুপ্রিম কোর্ট বারের সভাপতি খন্দকার মাহবুব হোসেন : খন্দকার মাহবুব বলেন, “অবসরের পর রায় লেখা সংবিধান পরিপন্থি- সুপ্রিম কোর্ট আইনজীবী সমিতির তরফ থেকে আমরা বারবার এই বিষয় বলেছিলাম। এখন প্রধান বিচারপতির বক্তব্যে এটি আরও স্পষ্ট হয়েছে।” তিনি বলেন, বিচারপতি এ বি এম খায়রুল হক নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকার সংবিধানের পরিপন্থি বলে যে রায়টি দিয়েছিলেন, তাতে তিনি সই করেন অবসরে যাওয়ার প্রায় ১৬ মাস পর। ফলে ত্রয়োদশ সংশোধনী বাতিলের ওই রায়ের সাংবিধানিক ভিত্তি নেই দাবি করে নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকার পদ্ধতি পুর্নবহালের রাজনৈতিক দাবিটি সংবাদ সম্মেলনে তোলেন সুপ্রিম কোর্ট আইনজীবী সমিতির সভাপতি। অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতি সৈয়দ আমিরুল ইসলাম বলেন, বিচারক যখন বিচারক হিসেবে অধিষ্ঠিত আছেন, তখন যদি তিনি রায়টা ঘোষণা করেন, পরে সে রায় লিখতে কোনো বাধা নেই। তিনি বলেন, এক্ষেত্রে বিচারক কিন্তু মামলার ফলাফল আগেই বলে দিয়েছেন, যা পরে লেখা হচ্ছে মাত্র। অবসর নেওয়ার পর বিচারক হিসেবে শপথ থাকে না বলে প্রধান বিচারপতির বক্তব্যের প্রতিক্রিয়ায় সৈয়দ আমিরুল বলেন, “উনি বলছেন বিচারক যখন শপথ নেয়, অবসরের গেলে আর শপথ থাকে না। “আমি বলতে চাই যখন শপথ থাকে না, অর্থাৎ আমি যখন শপথে নেই, তখন আমি নতুন করে কোনো রায় দিতে পারব না। কিন্তু আমি যখন বিচারক ছিলাম তখন যে রায় ঘোষণা করেছি, সেই রায়টা অবসরে গিয়ে লিখতে আমার সাংবিধানিক বা আইনগত কোনো প্রতিবন্ধকতা আছে বলে আমি মনে করি না।” নিজ জীবনের অভিজ্ঞতা তুলে ধরে বিচারপতি সৈয়দ আমিরুল বলেন, “আমি ১২ জানুয়ারি ২০০৭ সালে অবসরে গেছি। আমি ২৮ ফেব্রুয়ারি ২০০৭ সাল পর্যন্ত আমার যে অসমাপ্ত লেখা রায়গুলো লিখেছি, রায়গুলো কিন্তু আমি মুক্ত আদালতে ঘোষণা করে দিয়েছি বিচারক থাকাকালে। “এটা কিন্তু এই উপমহাদেশের সব জায়গায় বহু দিন যাবৎ চলে আসছে। বাংলাদেশ হওয়ার পরে, বাংলাদেশ হওয়ার আগে, পাকিস্তান আমলেও এই পদ্ধতি চলে আসছে।”
বিচারপতি সৈয়দ আমিরুল ইসলাম : প্রধান বিচারপতির বক্তব্যে আইনি কোনো জটিলতা দেখা দেবে বলে মনে করেন কি না-জানতে চাইলে অবসরপ্রাপ্ত এই বিচারপতি বলেন, এই বাণীটি বিচারিক কোনো ঘোষণার অংশ নয়। “তবে আমরা ধরে নিতে পারি এ রকম কোনো একটা সমস্যা যদি আদালতের সামনে আসে, হয়ত তিনি এই মতটাই পোষণ করবেন। এটা নিয়ে অচলাবস্থার সৃষ্টি হবে কি হবে না, সেটা নির্ভর করবে পরবর্তী পর্যায়ে এমন কোনো মামলা আসে কি না আদালতে, তার উপর।” ত্রয়োদশ সংশোধনী বাতিলের রায় ‘অবৈধ’ বলে বিএনপি সমর্থকদের বক্তব্যের বিষয়ে সৈয়দ আমিরুল বলেন, “আমি যতটুকু জানি, যেমন ত্রয়োদশ সংশোধনীর রায় কিন্তু শুনানির পর তাৎক্ষণিকভাবে শর্ট অর্ডারটা আদালত বলে দিয়েছিল। পরে পূর্ণাঙ্গ রায়টা প্রকাশ করেছেন। “উনি (প্রধান বিচারপতি) বলেছেন, অবসরে যাওয়ার পর রায় লিখতে পারবেন না, সেটি দিয়ে তিনি যদি এই বোঝান যে কোনো কোনো ক্ষেত্রে যদি এমন হয়ে থাকে, আপনি একটি মামলা শুনানি করলেন, কিন্তু রায়টা দিলেন না, অপেক্ষমান রাখলেন, ইতোমধ্যে অবসরে চলে গেলেন, তখন এ প্রশ্নটি দেখা দিতে পারে।” বিচারপতি খায়রুল হক নেতৃত্বাধীন আপিল বিভাগ সংবিধানের ত্রয়োদশ সংশোধনী অবৈধ বলে রায় দিয়েছিল। ‘শর্ট অর্ডারের’ পর আওয়ামী লীগ সরকার সংবিধান সংশোধন করে তত্ত্বাবধায়ক সরকার পদ্ধতি বিলুপ্ত করে সংবিধানের পঞ্চদশ সংশোধনী আনে। তত্ত্বাবধায়ক সরকার পদ্ধতি বিলুপ্তির প্রতিবাদে বিএনপি আন্দোলনে নামে। দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচন বর্জন করে তারা নির্দলীয় সরকার পদ্ধতি সংবিধানে যোগ করার দাবি এখনও জানিয়ে আসছে। বিএনপি চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা খন্দকার মাহবুব সংবাদ সম্মেলনে বলেন, “ক্ষমতাসীন সরকার ওই অবৈধ রায়ের সুযোগে সংবিধানের পঞ্চদশ সংশোধনী দ্বারা নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের বিধান বিলুপ্ত করে। “আজকে রাজনৈতিক অঙ্গনে সুষ্ঠু নির্বাচনের অভাবে যে সঙ্কট, অস্থিরতা এবং রাজনৈতিক হানাহানি চলছে তার একমাত্র কারণ নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচন পদ্ধতি বাতিল করে ক্ষমতাসীন দলের অধীনে নির্বাচন। আর এই বাতিলের পেছনে রয়েছে সংবিধান পরিপন্থি অবৈধ ওই রায়।”
অ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম : তার এই বক্তব্যের প্রতিক্রিয়ায় অ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম বলেন, প্রধান বিচারপতির বক্তব্যের ‘অপব্যাখ্যা’ করা হচ্ছে। “এটি সম্পূর্ণ রকমভাবে একটি রাজনৈতিক ফায়দা লোটার একটি প্রয়াস। প্রধান বিচারপতির বক্তব্যটাকে লুফে নিয়ে সেই বক্তব্যের একটি অপব্যাখ্যা করে তারা ত্রয়োদশ সংশোধনী সম্পর্কে বলছেন এবং সরকারের বৈধতা সম্বন্ধে বলছেন। এটি সম্পূর্ণভাবে অগ্রহণযোগ্য এবং তাদের বক্তব্যটাই অসাংবিধানিক ও বাস্তব অবস্থা বিবর্জিত।” সূত্র : বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম